গর্ভকালীন ডায়বেটিসের চিকিৎসা



গর্ভাবস্থায় যদি আপানার ডায়বেটিস ধরা পড়ে, নিয়মিতভাবে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে, আপনাকে তা নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
কারো কারো ক্ষেত্রে শুধু খাবার নিয়ন্ত্রন এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব। বাকীদের ওষুধের প্রয়োজন হয়।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পর্যবেক্ষণ
ডাক্তার আপনাকে শিখিয়ে দিবেন, কি করে নিয়মিত ভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করতে হয়। ডাক্তার আপনাকে এটাও বুঝিয়ে দিবেন আপনার গ্লুকোজের মাত্রা কত থাকতে হবে।
রক্তে গ্লুকোজ পরিমাপের হিসাব হলো, প্রতি লিটার রক্তে কত মিলিমোল গ্লুকোজ আছে। সংক্ষেপে এটাকে mmol/L এই ভাবে লেখা হয়।
দুই পরিস্থিতিতে নিয়মত ভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করতে হয়
খালি পেটে (৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর সকাল বেলা)
খাবার ১ ঘণ্টা পর
এই দুই ক্ষেত্রে আপনার গ্লুকোজের মাত্রা কত থাকতে হবে, ডাক্তার তা নির্ধারণ করে দিবেন। কখন এবং কতবার আপনার পরীক্ষা করাতে হবে তাও ঠিক করে দিবেন। এমনও হতে পারে গর্ভাবস্থার পুরো সময়টা প্রতিদিন খালি পেটে এবং সকাল, দুপুর এবং রাতে খাবার পর আপনাকে রক্ত পরীক্ষা করাতে হতে পারে।
আপনার ডায়বেটিসের চিকিৎসায় যদি ইনসুলিন নিতে হয়, তবে রাতে ঘুমাতে যাবার আগেও একবার পরীক্ষা করাতে হবে।
খাদ্যাভ্যাস
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য আপনাকে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বলা হবে। একজন পুষ্টিবিদ (dietitian) এ ব্যপারে আপনাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারবেন। তিনি আপনাকে বুঝিয়ে দেবেন, কোন খাবারে শর্করা বেশি, কোন খাবারে কম। সকাল, দুপুর এবং রাতে আপনার খাবার তালিকায় কি কি থাকবে তা তিনি ঠিক করে দিবেন।
এক্ষেত্রে পুষ্টিবিদ আপনাকে যে সব বিষয়ে পরামর্শ দিবেন, তা হলো
১। নিয়মমত খাওয়া
কোন অবস্থাতেই কোন বেলার খাবার বাদ দেয়া যাবে না। নিয়ম করে প্রতিবেলা সুষম খাবার খেতে হবে। খাবারের শর্করা অংশ টুকু তরল ও নরোম না হয়ে, শক্ত ও আঁশ যুক্ত হলে ভাল। দুই আহারের মাঝখানে বেশি সময় এটি পেটে থাকবে এবং ধীরে ধীরে রক্তের সাথে মিশবে, ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম বেশি হবে না। এই জাতীয় শর্করা খাবার হলো – লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, নতুন আলু, মিষ্টি আলু, ইত্যাদি। এই আঁশযুক্ত খাবার গুলো হজমেও সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
বেশি করে ফল ও সবজি খাওয়ার অভ্যাস করুন। দিনে অন্তত পাচ টুকরা (প্রতিটি ৮০ গ্রাম) ফল খান, তবে একবারে একটির বেশি না। এগুলো আপনার ভিটামিন এবং মিনারেলের চাহিদা মিটাবে, খাবারে আঁশের পরিমাণও বাড়াবে। আপনার খাবারে ডাল রাখুন, বিশেষ করে মুসুরির ডাল।
মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খান, তবে একেবারে বন্ধ করা যাবে না। খাবার সুষম হতে হলে, শর্করাও থাকতে হবে। সরবতে চিনি খাবেন না, বাজারে যে সব কোমল পানীয় পাওয়া যায়, সেগুলো খেতে হলে সুগার-ফ্রি টা খান।
আপনাকে আমিষও খেতে হবে, তবে তার মধ্যে চর্বি থাকা যাবে না। যেমন – মাছ। সপ্তাহে দুই টুকরা (প্রতিটি ৮০ গ্রাম) মাছ খান। তার মধ্যে এক টুকরা হতে হবে তেলযুক্ত মাছ যেমন, পাঙ্গাস মাছ, আইড় মাছ। এ বিষয়ে আরো জানতে পড়ুন ‘গর্ভাবস্থায় কি খাবেন’ এবং ‘গর্ভাবস্থায় কি খাওয়া যাবে না’ ।
আপনার খাবারে কিছু চর্বি জাতীয় উপাদানও থাকতে হবে, তবে সেটি হতে হবে আনসেচ্যুরেটেড চর্বি (unsaturated fat)। চর্বি দুই রকমের হয়, সেচ্যুরেটেড (যেমন, ঘী, বাটার, মাখন, ক্রীম, পনির) – যা ক্ষতিকর এবং আনসেচ্যুরেটেড –যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। আনসেচ্যুরেটেড চর্বি আবার দুই রকমের। পলি-আনসেচ্যুরেটেড (যেমন, সূর্যমুখী ফুল, সয়াবিন, বাদাম, বিভিন্ন দানাদার শস্য এবং এগুলোর তেল), মনো-আনসেচ্যুরেটেড (যেমন, জলপাই, চীনা বাদাম এবং এগুলোর তেল)। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য কিছু পরিমান আনসেচ্যুরেটেড চর্বি প্রয়োজন, এটি রক্তের কোলেস্টেরলও কমায়। কোলেস্টেরল বেশি হলে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে হৃদরোগের ঝুকি বেড়ে যায়।
ক্যালোরি
যদি গর্ভধারণের আগেই আপনার ‘শরীরের ভরের সূচক’ (body mass index – BMI ) ২৭ এর বেশি হয়, তবে গর্ভাবস্থায় আপনাকে কম ক্যালোরি খেতে বলা হবে। ‘স্বাস্থ্যসম্মত ওজন পরিমাপের ক্যালকুলেটর’ () ব্যবহার করে সহজেই আপনি আপনার BMI বেড় করতে পারবেন। তবে এটি করতে হবে গর্ভধারণের আগে, গর্ভাবস্থায় এই হিসাব আপনার জন্য প্রযোজ্য হবে না।
২। ব্যায়াম
শারীরিক পরিশ্রম রক্তে গ্লুকোজের পরিমান কমিয়ে দেয়। তাই ব্যায়ামের মাধ্যমেও আপনি আপনার ডায়বেটিস কে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারেন। যদি গর্ভধারণের আগেই আপনার ‘শরীরের ভরের সূচক’ (body mass index – BMI ) ২৭ এর বেশি হয়, তবে গর্ভাবস্থায় আপনাকে মাঝারি মাপের কিছু ব্যায়াম দেয়া হবে, যে গুলোতে আপনার হৃদস্পন্দন ও শ্বাসের হার বাড়বে, কিছুটা ঘাম হবে যেমন, সাইকেল চালানো, জোরে হাঁটা ইত্যাদি। সপ্তাহে মোট আড়াই ঘণ্টা এ ধরনের ব্যায়াম করতে হবে।
৩। ওষুধ
যদি খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে আপনার ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে না আসে, তবে আপনাকে ওষুধ দেয়া হবে। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনের কয়েক রকম ওষুধ আছে। আপনাকে কোনটি দেয়া হবে সেটা নির্ভর করছে,কোন ওষুধ আপনার ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী হবে, তার উপর। আপনার পছন্দও এখানে বিবেচনায় নেয়া হবে।
ডায়বেটিসের ওষুধ
ইনসুলিন
মেটফরমিন (Metformin) এবং গ্লিবেনক্লামাইড ( glibenclamide) – ট্যাবলেট হিসাবে
তবে সন্তান প্রসবের পর পরই এই ওষুধ বন্ধ করে দেয়া হবে।
ইনসুলিন
যদি আপনার শরীর ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়ে পড়ে, অর্থাৎ শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের সংস্পর্শে আসলে যে রকম সাড়া (respond) দেয়ার কথা, সে রকম সাড়া দিতে না পারে, তখন আপনাকে ইনসুলিন দেয়া হবে, যেন আপনার রক্তে ইনসুলিনের পরিমান পর্যাপ্ত থাকে, যার মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ইনসুলিন ইনজেকশন হিসাবেই নিতে হয়। এটি ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে খাওয়া যায় না, কারন এটি আমাদের পাকস্থলীতে গেলে, ওখানে যে এনজাইম থাকে তার সাথে বিক্রিয়া করে কার্যকারিতা হারায়। ইনসুলিন ইনজেকশন নেয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে যে বিষয় গুলো জানতে হবে
শরীরের কোন অংশে, কিভাবে এই ইনজেকশন নিতে হয়
ইনজেকশন কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয়, ব্যবহারের পর সিরিংজ, সূই কিভাবে ধ্বংস করতে হয়
ইনসুলিন কয়েক ধরনের হয়
১। দ্রুত কার্যকরী ইনসুলিন – এস্পারট বা লিসপ্রো (Rapid acting insulin analogue – aspart or lispro) – এটি খাবার আগে বা খাবার ঠিক পরেই নিতে হয়। এটি দ্রুত কাজ শুরু করে কিন্তু বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না
২। বেজাল ইনসুলিন – ইন্সুল্যাটারড বা ল্যানটাস (Basal insulin – insulatard or lantus) – এটি রাতে ঘুমানোর আগে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে নিতে হয়। বেশি সময় ধরে এটি কার্যকরী থাকে। দুই আহারের মাঝখানের সময়টুকুতে এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
এই দুই ধরনের ইনসুলিনই গর্ভাবস্থায় নিরাপদ। তবে যখনই আপনি এই চিকিৎসা গ্রহন করবেন, আপানার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাকে নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নিয়মিত যেভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করবেন
খালি পেটে (৮ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার পর সকাল বেলা)
প্রধান খাবারের (সকাল, দুপুর এবং রাত) ১ ঘণ্টা পর
প্রয়োজনে যে কোন সময় (যদি খারাপ লাগতে থাকে, যদি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেছে বলে সন্দেহ হয়)
মুখে খাবার ডায়বেটিসের ওষুধ
ডাবেটিসের চিকিৎসায় মুখে খাবার ওষুধ কখনো কখনো ইনসুলিনের সাথে কখনও একাই ব্যবহার করা হয়। এই ক্ষেত্রে যে দুটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়
মেটফরমিন (Metformin) এবং
গ্লিবেনক্লামাইড ( glibenclamide) – গর্ভাবস্থার ১১ সপ্তাহ থেকে দেয়া হয়
এই ওষুধ দুটির সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো
বমি বমি ভাব
বমি
ডায়রিয়া
ইনসুলিনের সাথে যদি গ্লিবেনক্লামাইড দেয়া হয়, তবে রক্তে হঠাৎ করে গ্লুকোজ কমে যেতে পারে, যেটাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (hypoglycaemia) বলা হয়। তবে মেটফরমিন এর ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। মেটফরমিন, ইনসুলিন এবং গ্লিবেনক্লামাইড এর সাথে নিরাপদে ব্যবহার করা যায়।
এই ওষুধ গুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে, ওষুধের সঙ্গে থাকা লিফলেটটি পড়ুন।
৪। গর্ভস্থ শিশুর পর্যবেক্ষণ
গর্ভকালীন ডায়বেটিস থাকলে আপনার গর্ভস্থ শিশুর কিছু জটিলতার ঝুকি থাকবে। যেমন, গর্ভকালীন সময়ের তুলনায় তার আকার বড় হতে পারে। এক্ষেত্র যাদের ডায়বেটিস নাই তাদের তুলনায় আপনাকে একটু বেশিবারই প্রসূতি-পূর্ব সেবার জন্য যেতে হবে, ডাক্তার একটু বেশি সময় নিয়েই আপানকে পরীক্ষা করবেন, আপনার অবস্থা এবং আপনার গর্ভের সন্তানের অবস্থা ভালমতো পরীক্ষা করে দেখবেন এবং সে অনুযায়ী আপনাকে পরামর্শ দিবেন।
যে কয়বার আপনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে
১৮ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে একবার – তখন আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করে দেখা হবে, আপনার গর্ভস্থ শিশুর হৃদপিন্ডে কোন জন্মত্রুটি আছে কিনা
২৮, ৩২ এবং ৩৬ সপ্তাহে আবার আলট্রাসনোগ্রাম করানো হবে। ৩৮ সপ্তাহ থেকে নিয়মিত ভাবে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি এবং অ্যামেনিওটিক ফ্লুইড এর পরিমান পরিমাপ করা হবে। অ্যামেনিওটিক ফ্লুইড হলো এক ধরনের বিশেষ তরল যার মধ্যে গর্ভস্থ শিশু ভেসে থাকে
সন্তান প্রসব
গর্ভকালীন ডায়বেটিস থাকার পরও আপানার গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি যদি স্বাভাবিক থাকে, তবে ৩৮ সপ্তাহ পর আপনাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রসবের কথাই বলা হবে।
এক্ষেত্রে হয়ত আপনাকে ‘ইন্ডাকশন’ (induction) দেয়া হবে। ‘ইন্ডাকশন’ হলো কৃত্রিম ভাবে প্রসব প্রক্রিয়া শুরু করানো। এতে আপনার যোনিপথে বিশেষ এক ধরনের ট্যাবলেট বা জেল দেয়া হবে এবং একইসঙ্গে শিরা পথে স্যলাইনের সাথে মিশিয়ে এক ধরনের হরমোন ওষুধ দেয়া হবে।
যতক্ষন পর্যন্ত আপনার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক থাকবে, আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষায় গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা ভাল দেখাবে এবং অন্যকোন সমস্যা থাকবে না, ততক্ষন পর্যন্ত আপনি স্বাভাবিক প্রসবের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।
আপনার ডায়বেটিসের কারনে গর্ভস্থ শিশুর আকৃতি যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়, তখন ডাক্তার আপনার সাথে প্রসবের বিকল্প পদ্ধতির বিষয়ে আলাপ করবেন।
ডায়বেটিস থাকলে আপনার শিশুর জন্ম অবশ্যই কোন হাসপাতালে হওয়া উচিত। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা থাকেন, প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের তাৎক্ষনিক সেবা পাওয়া যাবে।
প্রসবের পুরো সময়টাতে প্রতি ঘণ্টায় ঘন্টায় আপানার রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখা হবে, এবং এই মাত্রা ৪ থেকে ৭ মিলিমোল/লিটার এর মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হবে।
যদি গর্ভাবস্থায় আপনি ইনসুলিন নিয়ে থাকেন, তবে প্রসবের সময়টাতেও আপনাকে ইনসুলিন দেয়া হবে। এক্ষেত্রে স্যলাইনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এটা দেয়া হবে, সঙ্গে গ্লুকোজের স্যলাইনও দেয়া হবে, যাতে ইনসুলিন ও গ্লুকোজের ভারসাম্য বজায় থেকে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক থাকে।
তথ্যসূত্র: www.maya.com.bd

Comments